পরিতোষ বড়ুয়া রানা, চট্টগ্রাম ;
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে ‘মেরিন ড্রাইভ’ স্বপ্ন দেখেছিল নগরবাসী—যা একদিকে নদীর সৌন্দর্য্য, অন্যদিকে আধুনিক সড়ক যোগাযোগে চট্টগ্রামের গৌরব হয়ে উঠবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ পরিণত হয়েছে হতাশার প্রতীকে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অধীনে বাস্তবায়নাধীন ‘কালুরঘাট-চাক্তাই সড়ক ও বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প’ বর্তমানে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির চরম উদাহরণ হিসেবে আলোচনায়।
২০১৮ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ আট বছর পেরিয়েও শেষ হয়নি। প্রাথমিকভাবে নির্ধারিত বাজেট ছিল প্রায় ১,৪০০ কোটি টাকা, কিন্তু এখন ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৭৭৯ কোটি টাকায়। ব্যয় বাড়লেও উন্নয়ন হয়নি—বরং জনগণের অর্থে চলছে ‘জসিম-অসীম-রাজীব’ ত্রয়ীর দুর্নীতির মহোৎসব।
মানহীন কাজ ও জাল রিপোর্টের অভিযোগ
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, সড়কের নিচে ব্যবহৃত পাইপগুলো মরিচা ধরা, বালুর সঙ্গে মেশানো হয়েছে পলিথিন ও কাদা। স্থানীয়দের অভিযোগ, ক্যামেরা আসলে পলিথিন সরিয়ে ফেলা হয় যাতে প্রমাণ না থাকে।
প্রকল্পের সরঞ্জাম তদারক কর্মকর্তা জসিম নিয়মিত এসব অনিয়ম ঢেকে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড–এর হয়ে কাজের মান যাচাই না করে কাগজে জাল রিপোর্ট জমা দেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, এই স্পেক্ট্রা প্রতিষ্ঠানটি এর আগেও একাধিক সরকারি প্রকল্পে নিম্নমানের কাজের জন্য কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল। তবুও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠানটি আবারও কাজ পেয়েছে।
একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“এই প্রকল্পে যে মানের উপকরণ ব্যবহৃত হচ্ছে, তা সরকারের অনুমোদিত মানের অর্ধেকও নয়। কাজের মান নিয়ে প্রতিবাদ করলে বদলির ভয় দেখানো হয়।”
প্রকল্প পরিচালক রাজীব দাশের নীরব ভূমিকা
প্রকল্প পরিচালক রাজীব দাশ পুরো পরিস্থিতি জেনেও নীরব দর্শকের ভূমিকায়। স্থানীয়রা বলছেন, তাঁর মৌন সম্মতি ছাড়া এমন বিশাল অনিয়ম সম্ভব নয়। প্ল্যানে থাকা কালভার্ট বাদ দিয়ে অনেক জায়গায় ড্রেনেজ পাইপ বসানো হয়েছে, ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই এলাকা তলিয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা মুন্না দে জানান,
“আমরা বললে জসিম মামলা দেওয়ার ভয় দেখায়। বলে, ‘সরকারি কাজের বিরোধিতা করলে জেল খাটবি।’”
ভূমি অধিগ্রহণেও চলছে লুটপাট
ভূমি অধিগ্রহণ পর্যায়ে চলছে ভয়াবহ দুর্নীতি। ২০১৭ সালের ‘অর্জন ও অধিগ্রহণ আইন’ অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যূনতম বাজারমূল্যসহ অতিরিক্ত ৩০০% ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান থাকলেও বাস্তবে কেউ পেয়েছেন ১২-১৪ লাখ, কেউ মাত্র ২-৩ লাখ টাকা।
কিছুক্ষেত্রে কোনো রসিদ বা সরকারি কাগজ ছাড়াই হাত বদল হয়েছে কোটি টাকার লেনদেন—যা সম্পূর্ণ বেআইনি।
ভয়ভীতি, মামলা ও চুপ থাকার নির্দেশ
অভিযোগ রয়েছে, জসিম ও তাঁর সহযোগীরা একটি চক্র গঠন করে স্থানীয়দের ভয়ভীতি দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেন।
‘সরকারি কাজে বাধা’, ‘চাঁদাবাজি’ ইত্যাদি অভিযোগে মিথ্যা মামলা দিয়ে আন্দোলন ঠেকানোর নজির রয়েছে।
স্থানীয় এক ভুক্তভোগী বলেন,
“জসিমরে কিছু বললেই কয়—তোকে পুলিশে দিবো। ভয় পেয়ে সবাই চুপ থাকে।”
দুর্নীতির শিকড় ও অবৈধ সম্পদ
তদন্তে উঠে এসেছে, প্রকল্পে নিয়োজিত এই ‘জসিম-অসীম গং’ কেবল সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেনি, বরং ভয়ভীতি দেখিয়ে জনগণকে বঞ্চিত করেছে।
অভিযোগ রয়েছে, এই কর্মকর্তারা ও তাদের আত্মীয়দের নামে একাধিক ফ্ল্যাট, গাড়ি ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মালিকানা পাওয়া গেছে—যা তাদের ঘোষিত আয়ের বহির্ভূত।
এমনকি প্রকল্পে নিয়োজিত ঠিকাদারি ইনচার্জ অসীম কুমার বাবুর বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে নিম্নমানের কাজ, বিল জালিয়াতি এবং রড-বালু সরবরাহে অনিয়মের।
স্থানীয় শ্রমিকরা জানিয়েছেন, অসীম নিয়মিতভাবে মানহীন উপকরণ ব্যবহারের নির্দেশ দেন এবং প্রকল্প পরিদর্শনকালে অনিয়ম ধামাচাপা দেন।
আইনি ধারা ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ৪০৯ ধারা অনুযায়ী—
“সরকারি অর্থ বা সম্পত্তির তছরুপে জড়িত কর্মকর্তার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।”
এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪–এর ২৬ ও ২৭ ধারা অনুসারে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপন করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
তবে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত কোনো কার্যকর তদন্ত বা আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
চট্টগ্রামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে
চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশা ছিল এই প্রকল্পের মাধ্যমে কর্ণফুলী তীরে হবে একটি আকর্ষণীয় মেরিন ড্রাইভ, যা পর্যটন ও অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। কিন্তু আজ সেখানে শুধু ধুলা, বালু আর জনদুর্ভোগ।
একজন প্রবীণ নাগরিক বলেন,
“সরকার উন্নয়নের টাকা দিচ্ছে, কিন্তু সিডিএর কিছু কর্মকর্তা সেই টাকা নিজেদের উন্নয়নে খরচ করছে। চট্টগ্রাম এখন লজ্জিত।”
অভিযুক্তদের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি
বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও প্রকল্প পরিচালক রাজীব দাশ, তদারক কর্মকর্তা জসিম ও ইনচার্জ অসীম বাবু–এর কারো সাথেই যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
বারবার কল দিলেও ফোন রিসিভ হয়নি বা মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রামবাসীর দাবি: দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই
চট্টগ্রামবাসীর একটাই দাবি—এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের কথায়,“আজ যদি জসিম-অসীম-রাজীবদের বিচার না হয়, তাহলে দেশের সব উন্নয়ন প্রকল্প একই পরিণতির দিকে যাবে।”
রাষ্ট্রের অর্থে পরিচালিত প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প জনগণের টাকায় গড়া। সেই প্রকল্প যদি কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের দখলে যায়, তাহলে উন্নয়ন নয়—নেমে আসে অবক্ষয়। কর্ণফুলী মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পের এই চিত্র তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এখন সময় এসেছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার।
এ জাতীয় আরো খবর..