×
  • প্রকাশিত : ২০২৫-১০-০৭
  • ৪৯ বার পঠিত

মুজাহিদ হোসেন,জেলা প্রতিনিধি নওগাঁঃ


পাহাড়পুরে অবস্থিত সোমপুর মহাবিহার বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত প্রাচীন বৌদ্ধবিহার। নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলা—এই গ্রামটিতে থাকা এই মহাবিহারটি পাল সাম্রাজ্যের সভ্যতা ও বৌদ্ধ শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটি বিশ্ব ঐতিহ্যবর্গে অন্তর্ভুক্ত করে।

আদি নির্মাণ-সময় ধরা হয় অষ্টম শতাব্দীর (পাল কাল) মধ্যে; সাম্রাজ্যে ধর্মপাল (Dharma Pāla) ও তাঁর উত্তরসূরি দেবপালদের আলোচ্যকালে সোমপুর মহাবিহারের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এই বিহারটি সেই সময়ে নানান ধর্মীয়-শিক্ষাগত কর্মকাণ্ডের জন্য বিশিষ্ট কেন্দ্র ছিল এবং নলন্দা, বিক্রমশীলা প্রভৃতি বিখ্যাত বিহারগুলোর সঙ্গে একাডেমিক যোগাযোগবহুল প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করত। পরবর্তী শতাব্দীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আক্রমণ ও পরিবর্তিত রাজ্য-সমর্থনের ফলে বিহারটি ক্ষতিগ্রস্ত ও পরিত্যক্ত হয়।

পাহাড়পুর মহাবিহারের মূল আকর্ষণ হল এর বিশাল চতুর্ভুজ পরিকল্পনা — কেন্দ্রীয় স্তূপাকৃতির মন্দিরকে ঘিরে ১৭৭টি সেল ও বহুসংখ্যক স্তূপ, মঠ এবং সহায়ক নির্মাণ। সংরক্ষিত বর্গকোণে ভেন্ডর ও তেরাকোটা প্যানেলে খোদাই করা ধর্মচরিত, দেবদেবী আয়াম ও জটিল অলংকরণ দেখা যায়। সমগ্র কমপ্লেক্স যান্ত্রিকভাবে পরিকল্পিত ও প্যালা স্থাপত্য-শৈলীর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আয়তনে এটি হিমালয়ের দক্ষিণে অন্যতম বৃহৎ মহাবিহার।

১৯৩০-১৯৫০-এর দশকে ব্রিটিশ ও পরে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এখানে বৈজ্ঞানিক খনন চালান; পরে ইউনেস্কো ও আন্তর্জাতিক দলগুলো মেরামত, সংরক্ষণ ও মানচিত্রণ কাজের মাধ্যমে সাইটের গবেষণা ও রক্ষণাবেক্ষণে সহযোগিতা করে। ইউনেস্কো ১৯৮৫ থেকে ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান ও টেকনিক্যাল সাহায্য প্রদান করে এসেছে। তবে অনেক তেরাকোটা ও মূর্তিকর্ম আবহাওয়া ও অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে সংকটের সম্মুখীন।

সোমপুর মহাবিহার শুধু নৈরাজ্য-প্রাচীন স্থাপত্য নয়; এটি ছিল এককালে দক্ষিন এশিয়ার বুদ্ধধর্মীয় শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র—পণ্ডিত, ভিক্ষু ও ছাত্রদের মিলনস্থল, যেখানে বৌদ্ধ তত্ত্ব, দর্শন, ভূগোল ও কুশলশিল্প বিকশিত হতো। স্থানীয় জনগণ ও বাংলাদেশের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসে পাহাড়পুর একটি গৌরবোজ্জ্বল স্থান হিসেবে বিবেচিত।

ইতিহাসে প্রত্নধ্বংস ও ঊষ্ম বলয়ের কারণে বহু অমূল্য ভাস্কর্য ও টেরাকোটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাছাড়া ঝড়, ভারি বৃষ্টিপাত, মাটির ক্ষয়, পর্যটনচাপ এবং সীমিত তহবিল—এসবই বড় চ্যালেঞ্জ। ইউনেস্কো ও জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংযুক্ত প্রকল্প চালাচ্ছে, তবে স্থানীয় সচেতনতা ও দীর্ঘমেয়াদি তহবিল প্রয়োজন।

পাহাড়পুরে আসা-যাওয়া সহজ: নওগাঁ/রাজশাহী থেকে সড়কপথে যাবার অপশন আছে; স্থানীয় গাইড থাকলে দর্শন আরও তথ্যবহুল হয়।

দর্শনার্থীদের জন্য সাইট-রুল মেনে চলা জরুরি: অবকাঠামোতে আঘাত না করা, নিদর্শন অপসারণ বা স্থানে পরিবর্তন করা অনুচিত।

স্থানীয় অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে সমর্থন করতে মাঝেমাঝে স্বল্পমূল্যের গাইড সার্ভিস, স্মারক সামগ্রী—এসব নিয়মিত ও নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত।

পাহাড়পুর বা সোমপুর মহাবিহার বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের এক মণি। এটি কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়—মধ্যযুগীয় বৌদ্ধ শিক্ষার স্মারক, অঞ্চলভিত্তিক সংঘটিত সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের নিদর্শন। স্থানীয় ও জাতীয় স্তরে এই সাইটের টেকসই সংরক্ষণ, পর্যটন-নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষণীয় প্রোগ্রামের আয়োজন জরুরি, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই ঐতিহ্যের যথাযথ মূল্যায়ন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
lube
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat