×
  • প্রকাশিত : ২০২৫-১১-০১
  • ১৪ বার পঠিত
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

আজ ২ নভেম্বর, জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস ২০২৫। এটি শুধু একটি দিবস নয়, বরং মানবতার উৎসব—যেখানে “দান” মানে কেবল বস্তু নয়, জীবন ও আলো দান। একদিকে রক্তের ফোঁটায় কারো জীবন বাঁচানো, অন্যদিকে মৃত্যুর পর নিজের চোখ দিয়ে কারো পৃথিবী দেখার স্বপ্ন—দুটিই মানবতার শ্রেষ্ঠ প্রতীক।

রক্তের এক ফোঁটা, জীবনের আশীর্বাদ

রক্ত এমন এক মূল্যবান উপাদান যা কোনো ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা যায় না। মানুষই পারে মানুষকে রক্ত দিতে। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ১২ থেকে ১৪ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়, অথচ নিয়মিত সংগৃহীত রক্ত তার তুলনায় অনেক কম। দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচার, সন্তান প্রসব বা ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ রক্তের জন্য অপেক্ষা করে।

একজন সুস্থ মানুষ মাত্র ৩০০ মিলিলিটার রক্ত তিন থেকে চার মাস পরপর দিতে পারেন—এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। বরং রক্তদানের ফলে শরীরে নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয়, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, নিয়মিত রক্তদানকারীদের শরীরে আয়রনের ভারসাম্য বজায় থাকে, রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা হ্রাস পায়, এবং মানসিকভাবে তারা থাকে প্রফুল্ল ও আত্মতৃপ্ত।

স্বেচ্ছায় রক্তদান মানে কেবল একটি চিকিৎসা সহায়ক কাজ নয়; এটি একজন মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার মহৎ দান। একজন রক্তদাতা হয়তো জানেন না—তার রক্তের ফোঁটায় কোনো মা সন্তানকে কোলে পেয়েছেন, কোনো বৃদ্ধ আবার জীবনের আলো দেখছেন, কিংবা কোনো শিশু হাসপাতালের বিছানায় হাসছে। এই আনন্দের মাপ হয় না—এটি কেবল অনুভব করা যায়।

ধর্ম ও নৈতিকতার চোখে রক্তদান

ইসলাম জীবনরক্ষাকারী প্রতিটি কাজকে ইবাদত হিসেবে দেখেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন“যে একজন মানুষকে বাঁচায়, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচাল।” (সূরা মায়িদা: ৩২) এই আয়াতই প্রমাণ করে যে, রক্তদান কেবল মানবিক কাজ নয়—এটি আধ্যাত্মিক দান, ইবাদতের অংশ। মানুষকে জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার চেয়ে বড় দান আর কিছু হতে পারে না। ইসলাম, হিন্দু, খ্রিষ্টান—কোনো ধর্মই জীবন বাঁচানোর দানকে নিষিদ্ধ করেনি। বরং ধর্মসমূহই মানুষকে অন্যের কল্যাণে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছে।

মৃত্যুর পরও দান সম্ভব — চক্ষুদান

রক্তদানের পাশাপাশি মানবতার আরেক মহান প্রতীক হলো মরণোত্তর চক্ষুদান। চোখ—যার মাধ্যমে আমরা দেখি পৃথিবীর রঙ, প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রিয়জনের মুখ। অথচ বাংলাদেশে প্রায় সাত লাখ মানুষ দৃষ্টিহীন, যাদের অনেকেই কর্নিয়া নষ্ট হওয়ার কারণে দেখতে পান না। কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করলে তাদের অনেকের দৃষ্টি ফিরে আসতে পারে—শুধু একজন চক্ষুদাতার কারণে।

মৃত্যুর চার থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে দাতার কর্নিয়া সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা যায় এবং অন্যের চোখে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। এক জোড়া চোখ মানে দুইজন অন্ধ মানুষের পৃথিবী দেখা সম্ভব। মৃত্যুর পরও কারো জীবনে আলো ফিরিয়ে দেওয়া—এটি এক অনন্য মানবিক উত্তরাধিকার।

চক্ষুদান আন্দোলনের পথিকৃৎ

বাংলাদেশে চক্ষুদান আন্দোলনের সূচনা করেন অধ্যাপক ডা. মোহিতুল ইসলাম। তিনি ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “চক্ষুদান সমাজ” এবং পরবর্তীতে “আই ব্যাংক অব বাংলাদেশ”। তাঁর উদ্যোগেই দেশে কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের যুগ শুরু হয়। পরবর্তীকালে অসংখ্য অন্ধ মানুষ আবার দৃষ্টি ফিরে পান।

কিন্তু দাতার সংখ্যা এখনও খুব সীমিত। কারণ সমাজে প্রচলিত নানা ভুল ধারণা—যেমন “চোখ দান করলে মৃতদেহ অসম্পূর্ণ থাকবে” বা “ধর্মে নিষিদ্ধ”—মানুষকে পিছিয়ে রাখছে। বাস্তবে এই ধারণাগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। ইসলামসহ কোনো ধর্মই চক্ষুদান বা অঙ্গদানকে নিষিদ্ধ করেনি। বরং যদি এর মাধ্যমে কারো দৃষ্টি ফিরে আসে, তবে সেটি সওয়াবের কাজ। মৃত্যুর পরও জীবন্ত এক দান—এটাই চক্ষুদান।

কুসংস্কার ভাঙতে হবে

আমাদের সমাজে এখনও কুসংস্কার প্রচলিত—অঙ্গদান মানে নাকি পরকালে ক্ষতি হবে বা মৃতদেহ বিকৃত হবে। কিন্তু এগুলো অজ্ঞানতার ফল। চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রমাণিত, কর্নিয়া সংগ্রহের সময় মৃতদেহের কোনো বিকৃতি ঘটে না; চোখের সৌন্দর্যও নষ্ট হয় না। বরং সেই দেহই হয়ে ওঠে মানবতার প্রতীক।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও অঙ্গদান একটি সওয়াবের কাজ। নবী করিম (সা.)-এর শিক্ষা হলো—মানুষের উপকার করা সর্বোত্তম কাজ। সুতরাং রক্তদান ও চক্ষুদান উভয়ই মানবতার পথে চলার এক দৃষ্টান্ত।

মানবতার সমাজ গড়তে স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ

সরকার ২০১৭ সালে ২ নভেম্বরকে “জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস” ঘোষণা করে। এই দিবসের লক্ষ্য—মানুষকে সচেতন করা, রক্তদাতাদের উৎসাহিত করা, এবং মৃত্যুর পর চক্ষুদানের প্রতিশ্রুতি বৃদ্ধি করা।

আজ দেশের নানা প্রান্তে অসংখ্য তরুণ সংগঠন এই মহান কর্মে যুক্ত—বিডি ব্লাড, ব্লাড ম্যান, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চোখের আলো ফাউন্ডেশন, লাইফসেভারসসহ আরও অনেক সংগঠন নিয়মিত রক্তদান ক্যাম্প, কর্নিয়া সংগ্রহ কার্যক্রম ও সচেতনতা প্রচার চালাচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে মানবতার আহ্বান—“আজ আমি রক্ত দিলাম, আপনি কবে?”—এটাই পরিবর্তনের সূচনা। তরুণদের নেতৃত্বেই এই আন্দোলন একদিন সবার হৃদয়ে পৌঁছে যাবে।

প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় রক্ত ও চক্ষুদান

আজ প্রযুক্তির কারণে রক্তদান আরও সহজ হয়েছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল অ্যাপ ও ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে দাতা খুঁজে পাওয়া যায়। “রক্ত চাই” লিখলেই কয়েক মিনিটের মধ্যে কেউ না কেউ সাড়া দেন।

একইভাবে চক্ষুদান প্রতিশ্রুতিও এখন ডিজিটালভাবে নিবন্ধন করা যায়। সরকার চাইলে জাতীয় ডেটাবেইস তৈরি করতে পারে, যেখানে রক্তদাতা ও অঙ্গদাতাদের তালিকা থাকবে। এতে জরুরি অবস্থায় দ্রুত সাড়া পাওয়া সম্ভব হবে। প্রযুক্তির এই ব্যবহার মানবতার সেবায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।

তরুণদের ভূমিকা

তরুণ প্রজন্মই রক্তদান ও চক্ষুদান আন্দোলনের প্রাণশক্তি। তাদের মধ্যেই আছে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, স্কুল বা মাদ্রাসায় যদি নিয়মিত রক্তদান ক্যাম্প, চক্ষুদান সচেতনতা কর্মসূচি ও মানবতার আলোচনা হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও উদার, দানশীল ও মানবিক হয়ে উঠবে।

তারা যদি বুঝতে পারে—এক ফোঁটা রক্ত কিংবা মৃত্যুর পর দুটি চোখ দান করা মানে দুটি জীবনকে আলোয় ফিরিয়ে দেওয়া, তাহলে এই দেশ অন্ধকারমুক্ত মানবতার বাংলাদেশে রূপ নেবে।

করণীয় পদক্ষেপ

১️. প্রতিটি হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি দপ্তরে নিয়মিত রক্তদান ক্যাম্প আয়োজন করা।
২️. ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করে চক্ষুদান বিষয়ে সঠিক ধারণা প্রচার করা।
৩️. গণমাধ্যমে রক্তদাতা ও চক্ষুদাতাদের বাস্তব গল্প প্রচার করা।
৪️.  মৃত্যুর আগে “চক্ষুদান প্রতিশ্রুতি কার্ড” পূরণে উৎসাহ দেওয়া।
৫️. জাতীয় পর্যায়ে রক্ত ও অঙ্গদাতা নিবন্ধন কার্যক্রম চালু করা।
৬️. তরুণ সংগঠনগুলোর জন্য অনুদান ও প্রণোদনা দেওয়া, যাতে তারা নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে পারে।

মানবতার এই দান কেন গুরুত্বপূর্ণ?

রক্তদাতা হয়তো কখনো জানবেন না, তার রক্তের ফোঁটায় কোনো মায়ের কোল ভরে গেছে, কোনো শিশুর প্রাণ বেঁচেছে, কিংবা কোনো রোগী নতুন জীবন পেয়েছেন। চক্ষুদাতা হয়তো দেখবেন না, কিন্তু তাঁর চোখে কেউ প্রথমবার সূর্যোদয় দেখছে, সন্তানের মুখ চিনছে বা বই পড়ছে। এই আনন্দ কোনো বস্তু দিয়ে মাপা যায় না—এটি হৃদয়ের অনুভূতি, মানবতার শুদ্ধতম প্রকাশ।

মানবতার সেবা মানে শুধু দুঃখে সহানুভূতি দেখানো নয়—কাজের মাধ্যমে অন্যের জীবন বদলে দেওয়া। রক্তদান ও চক্ষুদান এমনই এক সেবা, যা মৃত্যুর সীমা অতিক্রম করে অন্যের জীবনে আলো জ্বালায়।

পরিশেষে বলতে চাই,জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের জীবন রক্ষার চেয়ে বড় দান নেই। আমাদের সমাজে যদি প্রতিটি মানুষ এই চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়, তাহলে বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের মানবতার বাংলাদেশ—যেখানে কেউ রক্তের অভাবে মরবে না, কেউ অন্ধত্বে অন্ধকারে থাকবে না।আসুন, আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি—
“বাঁচার সময় রক্ত দেব, মৃত্যুর পর চোখ দিয়ে যাব পৃথিবীতে আলো ছড়ানোর উত্তরাধিকার।”মানুষ বাঁচানোই মানবতার শ্রেষ্ঠ দান,
আলো ছড়ানোই জীবনের সত্য মান।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
lube
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat